নিজস্ব সংবাদদাতা: গত পাঁচ দিন ধরে পথ হাঁটছিল ৩শিশু সহ ৯জন। মহারাষ্ট্রেরর মালেগাঁও জেলার তিনটি পরিবার যাঁদের সঙ্গে ছিল ৭,৬ আর ৪ বছরের তিনটি শিশু। নেহাৎই দিন মজুর। খেটে খুটে সংসার চালাতে ছিল বর্ধমানে কিন্তু লকডাউন তছনছ করে দেয় সব কিছু। তিনটি পরিবারে তিন মহিলা ও তিন পুরুষ ও তাঁদের তিন সন্তান কার্যত অথৈ জলে পড়ে যায় যখন লকআউট ঘোষিত হয়। যেখানে কাজ করত তারা এঁদের বাড়ি চলে যেতে বলে। দোকানপাট বন্ধ, টাকা থাকলেও খাবার নেই, খাবার যদিও বা জোটে থাকার জায়গা নেই। এমতাবস্থায় বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তিনটি পরিবার কিন্তু সেখানেও বাধা, ট্রেন নেই, বাস নেই! অগত্যা পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা।
ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে ওই ৯জন সদস্যর একজন সাহেব রাও অশ্রু কালাপাদ জানিয়েছেন, ”আমরা মূলত পীচ রাস্তার কাজ করি। গত কয়েকমাস ধরেই বিভিন্ন ঠিকাদারের অধিনে এই কাজ করছিলাম। কিন্তু লকডাউন হয়ে যাওয়ায় আমাদের বাড়ি ফিরতে বলা হয়। আমরা অথৈ জলে পড়ি কারন কোনও বাস বা ট্রাক কিছুই চলছেনা। এরপর আমরা হেঁটে হাওড়া আসার সিদ্ধান্ত নেই। তিনদিন হাঁটার পর হাওড়া এসে পৌঁছে দেখি বাস চলছেনা। এরপরই আমরা ঠিক করি খড়গপুর যাব। সেই ভাবে হাঁটতে হাঁটতে শুক্রবার রাতে খড়গপুর এসে পৌঁছাই।”
দলের আরেক সদস্যা লক্ষীবাই জানিয়েছেন, ” প্রায় ২৫০কিলোমিটার হাঁটছি আমরা। পথে পেট্রোলপাম্প, বাসস্টপেজ যেখানে পেরেছি রাত কাটিয়েছি। কোথাও কেউ কেউ খাবার দিয়েছে আবার কখনও পুরো একদিন খাবার জোটেনি। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে বাচ্চাদের। ওদের পা ফুলে গেছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল বারবার। ওরা কাঁদছিল আর বলছিল আর কোনও দিন কাজে আসবেনা তোমরা। কিন্তু কাজ না করে আমরা খাব কি করে বলুন।”
শুক্রবার রাতে খড়গপুর শহরের একটি গুরুদুয়ারে রাত কাটানোর পর শনিবার এই তিনটি পরিবার হাঁটা দিয়েছিলেন রেল এলাকার মথুরাকাটি নিমপুরা সড়ক ধরে। উদ্দেশ্য মুম্বাই রোডে যদি মহারাষ্ট্রগামী কোনও লরি মিলে যায় । এই সড়কের ওপর দেখতে পান নবীন কুমার শর্মা নামে একজন রেলকর্মী তথা সমাজসেবী। নবীন জানান, ” ওরা আমাকে খাবার চাইছিল। আমি ওদের একটি দোকানে খাওয়ানোর পর কিছু টাকা দিয়েছিলাম ভবিষ্যৎয়ের জন্য কিন্তু পরে ওরা যখন বলল যে ওরা মহারাষ্ট্র ফিরতে চায় তখন আমি যোগাযোগ করলাম আমাদের কাউন্সিলরের সঙ্গে।
১৫নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অঞ্জনা সাকরে, নবীন ও আরও কয়েকজন তাঁদের কে নিয়ে আসে গোলবাজারে। গলাবাজার দক্ষিনবঙ্গের সবচেয়ে বড় পেঁয়াজ আড়ত। এখানে মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে পেঁয়াজ আসে লরি করে। সেই রকম একটি লরিতে করে ফেরার ব্যবস্থা হয়ে গেল ৯জনের । সেই বাবদ কিছু টাকাও দেওয়া হল লরির চালক ও খালাসীদের। সমস্ত আইনি ব্যবস্থা সেরে দিল খড়গপুর টাউন থানা।
শনিবার দুপুরের দুচোখ ভরা আনন্দের জল নিয়ে গোলাবাজার থেকে লরিতে চেপে বসলেন ৯জন। শিশুদের মাথায় বারবার হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন নবীন আর অঞ্জনা। মহারাষ্ট্রের তিন মহিলা জড়িয়ে ধরছিলেন অঞ্জনাকে। নবীন আর অন্যদের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন তিন শ্রমিক। খড়গপুরের হাত ধরে বাংলা আর মহারাষ্ট্র যেন মিলে মিশে একাকার। একটা লকডাউন, একটা বিপদ শিখিয়ে দিয়ে গেল কতকিছু ?